‘এতো রাতে ফেবুতে কি??’-কিবোর্ডে খটখট শব্দ তুলে ম্যাসেজটা টাইপ করেই সেন্ড অপশনে ক্লিক করলো এষা।
‘কিছুনা।‘ ওপাশে থাকা আবীরের ছোট্ট উত্তর।
‘কাল তুমি ফ্রি থাকবে। একটু লেকের ঐদিকটায় যেতাম। অনেকদিন যাওয়া হয়না।’–ম্যাসেজটা পাঠিয়েই গ্রামীণ মডেমটা একটানে পিসি থেকে খুলে ফেললো এষা। ডিসকানেক্ট করার ধার ধারেনা ও।
উফ! আবীরটা যে কি টাইপ করছে–ভাবছে এষা। রিপ্লাইটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে এষার। ম্যাসেজ সিন করেছে আবীর–দেখেছে সে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে গলা চেপে আটকে রাখল এষা। সকালেই দেখবে সে। ভাবতেই এখন ভালো লাগছে। কত্ত কল্পনা করা যাবে সারারাত! অসহ্য আনন্দ!
নরম বিছানায় শুয়ে শুয়ে এষা ভাবছে-‘আবীর কি আসবে কাল? না আসবেনা? উহু সে আসবে। জানি আমি। আমি কোন আবদার করেছি আর আবীর সেটা রাখেনি এমন কি হয়েছে কখনো?’
ফরসা গাল দুটো মাঝে মাঝেই রাঙা হয়ে উঠছে এষার। ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসির রেখা। ‘কাল তোমাকে বলেই দেব আবীর সাহেব–ভালবাসি। তারপর লেকের স্বচ্ছ পানিতে নৌকায় ভাসবো দুজনে। লেকের মাঝের পদ্ম ফুলটা দিয়েই তোমাকে প্রপোজ করবো। এ্যই, রাজী হবে তো তুমি?’
‘সব সম্পর্কই ছেলেরা শুরু করে–এই ফিলোসফি কাল ভেঙে দেবো আমি। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি আবীর। অনেক.. অনেক।’
‘প্রথম দেখাতেই প্রেমে কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না আমি। ভাবতাম ওসব কেবল গল্পের পাতাতেই মানায়। বাস্তব যে গল্পের চেয়েও অনেক বেশী কিছু– তোমাকে না দেখলে কখনো হয়তো বুঝতেই পারতাম না আমি। কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যখন তোমাকে প্রথম দেখি তখনই আমার জীবন আবার ওলট পালট করে দিয়ে ঘটলো রবি ঠাকুরের চৈত্র মাসের সর্বনাশ। কি ছিল তোমার মাঝে বলো তো? তোমার মাঝে ঐদিন শূন্যতা খুঁজে পেয়েছিলাম আমি, জানো আবীর। হ্যাঁ, শূন্যতা। আমি ঐ শূন্যতা চিনতাম আবীর। আমার চেয়ে ভালো ঐ শূন্যতা কেউ কখনো চিনবে না। পারবেও না। ঐ শূন্যতাটাই যে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমি। তীব্র রকমের হাহাকার নিয়ে ডুঁকরে ডুঁকরে কেঁদে উঠেছি প্রতিরাতে, আবার সকালবেলা চোখ মুছে ভালো থাকার অভিনয় করে গেছি প্রতিনিয়ত–নিজের সাথেই। আমার জীবনে প্রথম আসা সেই মানুষটা যে আমাকে একেবারে ভেঙে রেখে চলে গেছে। সে আমাকে ভালোবাসেনি এটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। কিন্তু প্রতারণাটা করলো কেন সে? কি অপরাধ ছিল আমার?
ছেলেদের প্রতি যে তীব্র বিষাক্ত ঘৃণা জন্মেছিলো আমার–তোমাকে দেখে তার অনেকটাই কেটে গেলো। আমি ভাবতাম ছেলেরা শুধু প্রতারণাই করতে জানে–ভালবাসতে শেখেনি কখনো। তোমাকে যতই দেখতে লাগলাম ততোই তোমার প্রতি ভালো লাগাটা হুহু করে বাড়তে থাকলো– নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো। ভালবাসা মানুষকে সত্যিই বেহায়া বানিয়েই ছাড়ে। ফ্রেন্ডদের এমন পরিস্থিতিতে যে আমি কখনো তা নেকামো ছাড়া আর কিছুই ভাবিনী, সেই আমিই তোমার জন্য নিজের সব দর্শন ভুলে গেলাম। কত অবলীলায় মেনে নিলাম আমি ভুল। একটু বেশিই রকমের ভুল।
আমার লাইফের প্রথম সম্পর্কটা থেকে যে পরিমাণ কষ্টটা পেতে হয়েছে আমাকে– এটা নিশ্চই তোমার থেকেও পেতে হবে না? তুমিও নিশ্চয়ই হুট করে চলে যাবে না। উঁহু, তোমাকে আমি জেতে দেব না। কোথাও না।
অনেক ভেবেছি আমি আবীর–গত কয়েকদিনে। প্রথমবারের মতো হুট করে রিলেশনে জড়াতে চাইনি। বুঝতে চেয়েছি তোমার জন্য আমার এ অনুভূতি ভালোবাসা না শুধুই ভালোলাগা। আবীর, তোমার মতো কাউকে শুধু ভালবেসেই সারাটাজীবন কাটানো যায়। খুউব অল্প একটু ভালবেসো আমায়? অল্প একটু।
আচ্ছা, কাল বিকেলে কি পড়বো আমি? শাড়ি? কোন রঙের শাড়ি? আবীর কে জিজ্ঞেস করে নেবো? না থাক।
নীল শাড়ি পড়বো কাল। নাহ কালো। কালো রঙই বেশি পছন্দ যে ওর।
ঘুম থেকে উঠেই ম্যাসেঞ্জারে ঢুকল এষা। বিছানায় শুয়ে শুয়েই। আবীরের নামটা সবার উপরে দেখাচ্ছে। সকাল সকালই মনটা অনেক ভালো হয়ে গেলো এষার।
‘হ্যাঁ, চারটার পরে পারব।’– আবীরের উত্তর।
এষার নরম আঙুলের হালকা চাপ পড়ছে স্মার্টফোনের স্কিনের উপর–
‘সাড়ে চারটায় আমি অপেক্ষা করবো, লেকের পাশে। তুমি এসো।’
বিকেলবেলা রোদ সামান্য একটু কমতেই এষা বাসা থেকে বের হয়ে পড়লো। সাড়ে তিনটা বাজে। লেকে যেতে যেতে খুব বেশি হলে চারটা বাজবে। আবীরের আগেই সে যেতে চায়। সেই অপেক্ষা করবে আবীরের জন্য। আর চিন্তা করবে বসে বসে। সারাদিন ভেবে ভেবেও ওর চিন্তা শেষ হয়নি। ভালবাসার নিয়মগুলাই মনে হয় এমন–প্রিয় মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা কখনোই শেষ হওয়ার নয়!
এষার মনে হচ্ছে–ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। গরমে ঘেমে যাচ্ছে ও। এমন সময় পেছন থেকে আবীরের চিরপরিচিত কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো এষা।
‘আজ এতো আগে যে?’-বলতে বলতে ধপ করে এষার পাশে বসে পড়লো আবীর।
‘এখনো কিন্তু সাড়ে চারটা বাজেনি। পনের মিনিট বাকিই আছে সাড়ে চারটার। তুমিও তো আগেই আসছো!’ লজ্জা পেয়েছে এষা।
“হাহা। আজকের বিকেলটা অনেক সুন্দর তাই না?”
“হুম। সাথে তুমিও।” পরের লাইন টুকু এমনভাবে বলল যেন আবীর শুনতে না পায়।
“কিছু বললে?”
“নৌকায় উঠবে আমার সাথে?”
“শিওর। কেন নয়? তুমি বসো; আমি নৌকার ব্যবস্থা করছি।”
একটু পরেই আবীরের ডাক শুনতে পেল এষা। আবীরকে কিভাবে তার ভালবাসার কথা জানাবে এটাই একমনে ভাবছিল সে। তাই আবীরের ডাক প্রথমে শুনতে পায়নি।
এষা নৌকায় ওঠার পর আবীর জিজ্ঞেস করল–
“আজ কি হয়েছে তোমার? কি ভাবছ এতো?”
“ক্ক..কই? কিছুনা তো”– তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিলো এষা।
আবীর আর কিছু বলল না এষাকে। বলতে যখন চাচ্ছে না থাক তাহলে।
লেকের স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে নৌকাটা ভেসে যাচ্ছে। আবীর বৈঠা চালাচ্ছে পানিতে আস্তে আস্তে। এষা এক পাশে বসে আছে। চোখে একরাশ মুগ্ধতা। ওর মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর হতে পারে না।
“ভয় লাগছে?” আবীরের ডাকে ঘোর ভাঙল এষার।
“তুমি আছো না! ভয় করবে কেন?” খুব বলতে ইচ্ছে করছে এষার। কিন্তু সাহসটাই করে উঠতে পারছে না।
“নাহ। বরং ভালো লাগছে।”–উত্তর দিলো এষা।
“হাহা। তাই?”
“হুমম। তাই।”
“ওকে। ঠিক আছে। সন্ধ্যা তো হয়ে আসছে। বাসায় যাবে কখন?”
“আমার তো তোমার সাথেই সবসময় থাকতে ইচ্ছে করে।”–বলতে ইচ্ছে করছে এষার।
“তোমার কি খারাপ লাগছে জায়গাটা?”- একটু অভিমানী সুরেই বলল এষা।
“না না তা হবে কেন?” বিব্রত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো আবীর। “আমি শুনেছিলাম জায়গাটা বিশেষ সুবিধার না। প্রতি রাতেই নেশার আড্ডা বসে এই জায়গায়।”
“স্যরি। চলো এখন চলে যাই।”– লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা।
“চলো।”
“আমি আসবো তোমার সাথে?” রিক্সায় উঠছিল এষা, এমন সময় প্রশ্নটা করলো আবীর।
“হুমম। এসো।” মনে মনে এটাই চাচ্ছিল এষা। প্রচণ্ড খুশি হয়েছে সে– দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে রিক্সা এষার বাসার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এষা ভাবছে–এখন আবীরকে বলতে না পারলে আর কখনোই “ভালবাসি” শব্দটা বলতে পারবে না সে।
“আবীর।”
“হুম। বলো।”
“তোমার হাতটা ধরতে পারি আমি?”
একদৃষ্টিতে এষার দিকে তাকিয়ে আছে আবীর। আস্তে আস্তে এষার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো সে। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে এষার গাল বেয়ে।
“সারাজীবন থাকবে তো আমার পাশে?”
“ভালবাসি।”
“আমিও। এতোগুলা।”
“রিক্সায়ই বসে থাকবে? নামবে না?” এষার বাসার সামনে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।
“হ্যাঁ। নামবো।”
“নামো।”
“বাসায় আসবে আবীর? আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোমাকে নিজের হাতে কফি বানিয়ে খাওয়াবো। প্লিজ।”
“হুমম…ওকে।” সদ্য শুরু হওয়া সম্পর্কের প্রথমেই গার্লফ্রেন্ডের অনুরোধ ফেলে দিতে পারে না কোন ছেলেই। শুধু বলল–
“আন্টি কিছু বলবে না তোমাকে। আগে তো কখনো আসিনি আমি তোমাদের বাসায়।”
“উঁহু। চলোতো।”
“চলো।”
“বাসায় কেউ নেই। আব্বু আম্মু ছোট আন্টির বাসায় গেছে। আজ হয়তো আসবে না।”
একটু বিব্রত বোধ করছে আবীর। একা একটা মেয়ে বাসায়। যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আবীর সত্যিই এষাকে ভালবাসে। আর তার চেয়ে বেশি এষাকে শ্রদ্ধা করে। বিয়ের আগে কোন ধরণের অনৈতিক সম্পর্কে যেয়ে এষাকে ছোট করতে সে কখনোই পারবে না।
“বোসো। আসছি আমি।”
“এষা, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি কোরো। কালকের এ্যাসাইনমেন্টটা এখনো করা হয়নি। রাতেই করা লাগবে।” এ্যাসাইনমেন্ট কালকে রাতেই করেছে আবীর। কিন্তু এখানে এখন থাকতে চাচ্ছে না সে।
“এ্যাসাইনমেন্ট আমি করে রেখেছি তোমারটা। যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।”
আবীর বুঝলো এষার নিজেরটাই আবীরকে দিয়ে দিবে মেয়েটা। কিন্তু কিছু বলল না।
কিচেনে শব্দ হচ্ছে। কফি বানাচ্ছে এষা।
“এই নাও।” কফির মগটা আবীরের হাতে ধরিয়ে দিলো এষা।
“এত্তো ভাআ…লো…।” কথাটা শেষ করতে পারলো না আবীর। তার আগেই ঘুমে ঢলে পড়লো। মাত্র দুটো চুমুক দিয়েছিলো সে কফিতে।
“কেমন ঘুম হলো আবীর সাহেব?” খসখসে কণ্ঠস্বরটা শুনে চমকে উঠলো আবীর। এটাতো এষার কণ্ঠ নয়! কিন্তু ওর সামনে তো এষাই দাঁড়িয়ে আছে!
আবীর ভয় পাচ্ছে– প্রচণ্ড। আবীরের হাত–পা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা। কোথায় সে? এটা তো এষাদের বাসায় নয়।
আবীরের মনের কথাটা বুঝতে পেরেই হয়তো অদ্ভুত কণ্ঠস্বরটা উত্তর দিলো-“এষাদের বাসায়ই আছি আমরা।
“মানে? এষা, এসব কি হচ্ছে।” ভয়ে ভয়ে বলল আবীর।
খসখসে কণ্ঠস্বরটা চেঁচিয়ে উঠলো–
“চুপ। বেশি কথা পছন্দ না আমার।”
এষার হাতের সার্জিক্যাল ব্লেডটা চোখে পরে গেছে আবীরের। আবীরের কপালের মাঝখানে হালকা টান মারলো এষা সার্জিক্যাল ব্লেডটা দিয়ে।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে আবীর তাকিয়ে আছে এষার দিয়ে। ওর চিরপরিচিত মেয়েটার সাথে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এষার কোনো মিলই নেই।
“আমি এষা নই।” হিসহিস করে কণ্ঠটা বলে উঠলো।
“হাহা…কি বোকা তুমি– পুরুষ মানুষ। হাহা…” হাসছে মেয়েটা। হাসতে হাসতেই আবীরের চোখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে সার্জিক্যাল ব্লেডটা।
চোখ দুটো গলে গেছে আবীরের। রক্তের ধারা ঝরছে গাল বেয়ে। ছেলেটাকে চিৎকার করার সময়টুকু দেয়নি মেয়েটা। তার আগেই গলাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে সে।
পরিশিষ্ট:
এষার বিছানার পাশে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। একটা মেয়ের ছায়া। যে মেয়েটাকে তার ভালবাসার মানুষটা দশ বছর আগের এই রাতেই এই বিল্ডিংটাতেই নৃশংসভাবে খুন করেছিলো। তাদের উথাল পাঠাল প্রেমের জোয়ারে যে নতুন প্রাণটার সৃষ্টি হয়েছিলো মেয়েটার ভেতরে; তাকে মেনে নিতে পরেনি ছেলেটা। ফলাফল খুন করে সে মেয়েটাকে। মেয়েটার লাশটাও কেউ কখনো খুঁজে পায়নি আর। একদৃষ্টিতে ছায়ামানবীটা এষার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। আবীরের সাথে সাথে এষাকেও ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো সে। অনুশোচনা হচ্ছে কিছুটা তার। এষার তো কোন দোষ ছিলো না। তাহলে তাকে কেন শাস্তি পেতে হলো– এতো কঠিন শাস্তি। কিন্তু এই রাতটায় যখন তার প্রতিশোধপরায়ণ মনটা তীব্রভাবে জেগে ওঠে তখন যে তার রক্ত না হলে চলে না। একদম চলে না।
ছায়াটা জানে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর মেয়েটা আর কখনোই আবীরকে খুঁজে পাবেনা। এমন কি তার ক্ষতবিক্ষত লাশটাও না। মেয়েটার ঐ সময়টার অনুভূতিটুকু খুব অনুভব করতে ইচ্ছে করে ছায়াটার। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়। কারন বিধাতা তাকে সে শক্তি দেয়নি যে।