“আঠারো তলার উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলাম আমি।“
হা করে তাকিয়ে আছি আমি রায়হানের দিকে। চোখে একরাশ অবিশ্বাস। কি বলছে ও এসব! আঠারো তলার উপর থেকে পড়ে গেলে মানুষ বাঁচে কিভাবে! আর এ ছেলেটা শুধু যে বেঁচে আছে তাই নয়, দিব্যি চলেফিরেও বেড়াচ্ছে। একটুও বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার ওর কথা। একটু বিদ্রূপের সুরেই বললাম–
“আজকাল গাঁজাটাজা ধরেছিস নাকি? আঠারো তলা মানে বুঝিস?”
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে রায়হান আমার দিকে। দৃষ্টিতে সামান্য আহত ভাব ফুটে উঠেছে।
লজ্জা পেলাম একটু। ছেলেটার সাথে পরিচয় অল্পদিনের হলেও বন্ধুত্ব ভালোই হয়ে গেছে। ওর মতো ভালো ছেলে আমার লাইফে দ্বিতীয়টা দেখিনি। পুরো ঘটনাটা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করায় ও বলা শুরু করলো–
“আঠারো তলার ছাদের ঢালাইয়ের কাজ করছিলাম।ঐসময়ই পড়ে গিয়েছিলাম। শরীর ধরে আমার পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন এক চাচা মিয়া, পারেননি। নিজেও পড়ে গেছেন আমার সাথে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে অকালে প্রাণটা খোয়াতে হলো তাঁকে। তাঁর শরীরটা দুই খণ্ড হয়ে গিয়েছিলো। ট্রাকের কোণার বডির উপর পড়েছিলেন তিনি। কয়েকরাত তো ঘুমাতেই পারিনি তাঁর দ্বিখণ্ডিত লাশটা দেখার পর। সবসময় চোখের সামনে ভাসতো ওই দৃশটা। অমন করুণ পরিণতি হওয়ার কথা তো ছিল আমার। অথচ তাঁর মতো ভালো মানুষটা মরে গেলো আমার চোখের সামনেই। আমাকেই বাঁচাতে গিয়ে।“
“তুই বেঁচে গেলি কিভাবে?” প্রশ্ন করলাম আমি। ওর গল্প শুনতে তেমন আগ্রহ পাচ্ছিনা। এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে আমার। হাতে কাজ নেই তেমন, তাই একা একা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার চেয়ে আপাতত ওর বকবক শোনাটাই ভালো মনে হচ্ছে।
“আমরা যে বিল্ডিংটাতে কাজ করছিলাম– তার পাশেই একটা কাগজের মিল ছিল। ট্রাকটা মিলেরই ছিল। কাগজ সমান করে কাটার পর যে উচ্ছিষ্ট অংশ থাকে তাই দিয়ে ভর্তি ছিল ট্রাকটা। এর উপরই পরেছিলাম আমি। যে কারণে আমার কিছুই হয়নি।“– রায়হান উত্তর দিল।
“কোথাকার ঘটনা এইটা?”
“ইন্ডিয়া।“
“ইন্ডিয়া! ইন্ডিয়ায় ছিলি কবে তুই? আগে বলিসনি তো?”
“তোকে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলি। না হলে বুঝবি না কিছুই। সব কিছুই জানতে পারবি তাহলে।“
”বলা শুরু কর তাহলে।“ – কিছুটা আগ্রহ পাচ্ছি এখন। ভালই লাগছে শুনতে।
চায়ের কাপটায় শেষ চুমুক দিয়ে রায়হান বলা শুরু করল– “আমার ছোট বেলার সময় থেকেই শুরু করি তাহলে। আমার জন্ম ১৮৫৭ সালে। সালটাই শুধু মনে আছে। দিন তারিখ মনে নেই। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ না হলে হয়তো সালটাও বলতে পারতেন না মা। বাবা–মা দুজনই নিরক্ষর ছিলেন। নিম্নশ্রেণীর মানুষের যা হয় আর কি– পড়াশোনার সুযোগ পাননি বাবা–মা কেউই। তবে মার মুখে শুনেছি লেখাপড়ার প্রতি বাবার অনেক আগ্রহ ছিলো।
থাকতাম মানিকগঞ্জের হিন্দু পাড়ায়। রায়হান আমার আসল নাম নয়। যাই হোক নামের বিষয়ে পরে আসি। আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বাবা মারা যায়। আমার মায়ের তখন বয়স অল্প। আঠারো কি উনিশ হবে। খুব সুন্দরী ছিলেন। আমার অবশ্য মায়ের মুখটা মনে নেই এখন। তো বাবা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়ির লোকেরা মাকে আবার বিয়ে দিলেন। মায়ের অবশ্য কিছুটা আপত্তি ছিল। তবে তার আপত্তি মামাদের কাছে টেকেনি। আমি তখন একেবারে ছোট। পাঁচ বছর বয়সে কিই বা আর বুঝি? এসব ঘটনা সব আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা।
আমার সৎবাবা মানুষটা ভালো ছিলেন না। মদ আর নারীর নেশা ছিল তার। মাকে অধিকাংশ দিনই মার খেতে হতো। আর বকা তো ছিল সাধারণ বিষয়। প্রতিরাতেই দেখতাম মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছেন। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার।
স্কুলের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল আমার ছোটবেলা থেকেই। তবে বেশিদূর পড়ার ভাগ্য আমার হয়নি। তৃতীয় শ্রেণির পাঠ চুকানোর আগেই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় আমাকে। ক্লাসেরই এক ছেলের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো। দোষটা ওই ছেলেরই বেশি ছিল। আমার মাকে নিয়ে অনেক অশালীন কথা বলেছিল। প্রথমে আমি তাকে কিছুই বলিনি। তারপরও ও অশালীন মন্তব্য করেই যাচ্ছিলো। একপর্যায়ে বিষয়টা আমি স্যারকে জানাই। কিন্তু তিনিও কিছুই বলেননি ওই ছেলেটাকে। কি বা আর বলবেন এলাকার চেয়ারম্যানের অল্প বয়সে বখে যাওয়া ছেলেকে। তৃতীয় শ্রেণিতে পরলেও বয়সে ও ছিল আমাদের অনেক বড়। দুই তিন বার ফেল করে এই অবস্থা, তখনো ক্লাস থ্রিতেই পড়ে ছিল । স্কুল ছুটির পর বাড়ি আসার পথে সে আবার শুরু করলো আমাকে উত্যক্ত করা। মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। রাস্তার পাশে রাখালদের ফেলে রাখা শক্ত লাঠি পড়ে ছিল। তুলে নিয়ে পেছন থেকে জোড়ে মেরেই দিলাম দৌড়। কি হয়েছিলো ওর তখন দেখার সময় পাইনি। রাতে আমার মদখোর সৎবাবার মুখে সব শুনতে পাই। সাথে তার বিখ্যাত বিলাতি বেতের বারি। সেই প্রথম আমার সৎবাবা আমার গায়ে হাত তুলে।
চেয়ারম্যান পরদিন স্কুলে ডেকেছিল আমাদের। কারণটা আগেই শুনেছি। মাথা ফেটে গিয়েছিল ওই ছেলের। বিচারে জোড় যার মুল্লুক তার নীতিতে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হল, সাথে দেওয়া হল সন্ত্রাসী উপাধি। আর কোন স্কুলে যেন ভর্তি হতে না পারি তার ব্যবস্থাও করা হল। আমার সাধের স্কুল জীবনের রঙিন অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটলো।
এরপর শুরু হল আমার ভবঘুরে বাউণ্ডুলে জীবন। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াই। রাতে বাড়ি ফিরলে শুরু হয় সৎ বাবার অত্যাচার। এভাবেই চলছিলো সব।
একদিন সব ওলটপালট হয়ে গেল। নেশার খরচ যোগাতে আমার সৎ বাবা আমাকে এক আদম বেপারীর কাছে সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিল। আমি বা আমার মা কেউই কিছুই জানতে পারলাম না। বাবা মাকে বলেছিলেন কাজ দেবে ওই লোকটা আমাকে। তিনিই আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যান।“
চুপচাপ শুধু শুনেই যাচ্ছি আমি। প্রশ্ন করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। কিই বা প্রশ্ন করবো আমি? এতো করুণ পরিণতি কারো হতে পারে! এর আগে কখনো কোন ভুক্তভোগীর সামনে বসে এমন করুণ ঘটনা শোনার ভাগ্য আমার হয়নি।
রায়হান আবার শুরু করলো-“ ইন্ডিয়ায় এক কৃষকের কাছে বিক্রি করে দেয় আমাকে সেই আদম বেপারী। সেই লোকটা খুবই ভালো ছিল। তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। বাবার আদর কেমন হতে পারে তাঁর কাছে থেকেই বুঝতে শিখি আমি। তবে তার বউ অর্থাৎ আমার মালিকিন খুব রাগী মহিলা ছিলেন। পান থেকে চুন খসলেই পেটানো শুরু করতেন।
বউ পাগল ছিলেন লোকটা। বৌয়ের কথার উপর কোন কথা বলতে পারতেন না। বউই ছিলো তাঁর সংসারের সর্বেসর্বা। সে যাই হোক বাড়ির কর্তা অর্থাৎ ওই কৃষক মারা যাওয়ার পর আমার উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ভাবলাম এখানে আর নয়, পালাতে হবে। একটানা আট বছর আমি ওই পরিবারের জন্য কলুর বলদের মতো খেটে গেছি। তার বিনিময়ে উপহার হিসেবে পেয়েছি শুধুই তিরস্কার। যার জন্য এতদিন এই পরিবারে ছিলাম সেই তো এখন আর নেই। পালানোর সুযোগ অবশ্য আগেও অনেক ছিল। কিন্তু আগে কখনো পালানোর কথা চিন্তা করিনি। কষ্ট হয়েছে অনেক তারপরও।
আট বছর পর যখন আমি ওই বাড়ি থেকে পালাই তখন আমার বয়স প্রায় বিশ। পকেটে ছিল অনেক কষ্টে জমানো তিন রুপি। তখনকার তিন রুপি মানে অনেক টাকা।
পালিয়ে আমি পশ্চিম বঙ্গে চলে আসি। পশ্চিম বঙ্গে আসতে আমার লাগে তিনদিন। রুপি যা সাথে ছিল সব শেষ। শূন্য পকেট, উদর একেবারে খালি। শুধু পানি খেয়ে কাটাতে হয়েছিলো ওই তিনদিন। পশ্চিমবঙ্গে যখন এসে পৌঁছাই তখন শরীরে আর একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। পশ্চিমবঙ্গে এসে এক মন্দিরে ঢুঁকে পড়ি। আমাকে দেখে পুরোহিত মশাইয়ের মায়া হয়। তিনিই আমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। খাওয়া–বিশ্রাম শেষে আমি তাকে সব খুলে বলি।
পুরুতমশাই এখানে আমার থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। একটা খাবারের দোকানে কাজ করতাম। রুটি বানাতাম আমি। টাকা যা পেতাম তার প্রায় সবটাই থেকে যেতো। একা মানুষ আমি কিই বা খরচ করবো? থাকা–খাওয়া তো বিনামূল্যেই পেতাম পুরুতমশাইয়েরই বাড়িতে।
এ ঘটনার দুই বছর পর ওই খাবারের দোকানটা আমি কিনে নেই। দোকানের মালিক হটাত মারা যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী দোকান বিক্রি করে দেয়।
খাবারের দোকানটা ভালোই চলতো। দিনশেষে প্রচুর লাভ অথচ আমার খরচ হয়না এক রুপি। তখনো পুরুতমশাইয়ের বাড়িতেই থাকতাম। আমি অন্য বাড়িতে উঠতে চেয়েছিলাম কিন্তু পুরুতমশাই উঠতে দেননি। সুখ কি জিনিষ জীবনে এই প্রথম তা আমি উপলব্ধি করতে পারি।
”বাড়িতে মা–বাবার খোঁজ করেছিলি তখন? আমি জিজ্ঞেস করি।
“হ্যাঁ, করেছিলাম। শুনতে পেয়েছিলাম মা–বাবা ঢাকায় থাকতেন তখন। কিন্তু খুঁজে পাইনি আমি কাউকেই।“
“তারপর কি হলো?
”ও হ্যাঁ। অর্থের মুখ দেখা শুরু করেছিলাম তখন। কিন্তু আমার কপালে সুখ বেশিদিন সহ্য হলো না। ভাগ্যদেবী আমাকে নিয়ে আবার খেলা শুরু করলেন।
পুরুত মশাইয়ের মেয়ে ছিলো একটা। সুন্দরী। সতের–আঠারো বয়স তখন। অলকা নাম। বিয়ে হয়নি তখনো।
এক সন্ধ্যায় পাড়ার বখাটে কিছু ছেলে অলকাকে মন্দিরের ভেতরেই ধর্ষণ করে। পুরুত মশাই বাঁধা দিতে যেয়ে ওদের হাতে খুন হন। আমি যখন মন্দিরে পৌঁছাই তখন সব শেষ। দুইজন মন্দিরের দুই কোনায় পড়ে আছে। পুরুত মশাই অনেক আগেই মারা গেছেন। অলকা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কুয়ো থেকে পানি এনে অলকার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেই। কাজ হয় এতে। জ্ঞান ফিরে আসে অলকার।
কিন্তু ওর বাবার অবস্থা দেখে আবার জ্ঞান হারায় মেয়েটা।
পরদিনই আমি অলকাকে বিয়ে করি। শুধু মালাবদল করে। এছাড়া আর কিই বা করার ছিলো আমার। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছে মেয়েটা। বাবার সাথে থাকতো। কিন্তু মাথার উপর সে ছায়াও তো আর থাকলো না। তাছাড়া অলকাকে মনে মনে পছন্দও করতাম আমি। কিন্তু তাদের বাড়িতে আশ্রিত থাকার লজ্জা অতিক্রম করে সে কথা অলকাকে কখনো বলার সাহস পাইনি।“
”তোর ভগবান তো তোর ইচ্ছাই পূরণ করে দিলো! একটু অন্যভাবে হলেও।“– একটু হাসলাম। এতক্ষণে ঠিকই বুঝে গেছি রায়হান সনাতন ধর্মের।
”হ্যাঁ। তবে ওই ঘটনার জন্য কিন্তু অলকার প্রতি আমার পূর্বের মনোভাবের একটুও পরিবর্তন হয়নি। সব পুরুষের কাছেই তার জীবনের প্রথম নারী সবসময়ই দেবী তুল্য–সে যেমনই হোক না কেন।
সে যাই হোক, আমার অলকা আর পূর্বের অলকা হতে পারলো না। হাসিখুশি মেয়েটা এক আশ্বিনা ঝড়ে চুপচাপ ঘরকুনো হয়ে গেলো।“
”পুলিশকে জানানো হয়নি?”
”পুলিশ? তারাই তো সবচেয়ে বড় অপরাধী। আইনের পোশাক পড়ে করে বেআইনি কাজ। প্রভাবশালী মানুষের বিচার করতে নেই–এই হচ্ছে আমাদের আইন। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সব শালা বেকসুর খালাস পেয়ে গেলো।“
মন্ত্রমুগ্ধের মতো রায়হানের কথা গিলে খাচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম-“তারপর কি হলো?”
গলা শুকিয়ে গেছে রায়হানের। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার বলা শুরু করলো রায়হান–
“অলকা আত্মহত্যা করলো।“
“কি?”
“হ্যাঁ, অলকা আত্মহত্যা করলো। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে।“
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এমন কিছু হতে পারে চিন্তাও করিনি আমি।
রুক্ষ গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল, হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলো রায়হান। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই।
“এরপর ভাবলাম– আমার নিরপরাধ স্ত্রীটা অভিমান করে অকারণে যাদের জন্য চলে গেলো–আইন তো ওদের স্পর্শ করতে পারলো না। ওই নর–পিচাশগুলা তো দিব্যি হেসে–খেলে বেড়াচ্ছে। অথচ ও নেই। নেই ও। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা নেই। সবচেয়ে পছন্দের মানুষটা নেই। আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেনি, ওকে খুন করা হয়েছে, খুন– আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকলো।
দিনের পর দিন ওই নরপিচাশগুলোকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি। আমার খোঁজা বিফলে যায়নি। আস্তে আস্তে সবগুলোকেই খুঁজে পেয়েছি। নিজ হাতে সব নরপিচাশগুলোকেই কঠিন শাস্তি দিয়েছি। অলকা যেভাবে মারা গেছে, সবগুলা কুত্তার বাচ্চাকেই একই ভাবে মেরেছি। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে। না হলে অলকার আত্মা যে শান্তি পাবে না।
পশ্চিমবঙ্গে আমার নামে হুলিয়া জারি করা আছে। ধরিয়ে দিতে পারলে পুরষ্কারও দেওয়া হবে সরকার থেকে। হাহা…“
বুঝলাম এজন্যই রায়হান পরিচয় গোপন করে আছে।
একটু থেমে রায়হান আবার বলা শুরু করলো–
“ শুধু তোকেই কখনো ধরতে পারিনি কবীর। বার বার হাতের নিচে পেয়েও পার পেয়ে গেছিস। আঠারো তালার উপর থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিলি। শুধু তোর কারণেই আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বৃদ্ধ লোকটা অকালে প্রাণ হারালো।
কি দোষ করেছিলো রে আমার স্ত্রীটা?“
“কি সব বাজে বকছিস? পাগল হয়ে গেলি নাকি?”–অবাক হয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছি। আল্লাহর কসম পশ্চিমবঙ্গ আমি কেনো, আমার বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ কখনো চোখেও দেখেনি। আর রায়হান বলছে আমি সেখানে ছিলাম। শুধু ছিলাম না, ওর বউকে নাকি ধর্ষণও করেছি আমি!
চমকে রায়হানের হাতের দিকে তাকালাম, রোদ পড়ে ওর হাতের ছুরির ফলাটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বুঝলাম না ওর হাতে ছুরিটা আসলো কিভাবে?
দর দর করে ঘামছি আমি। ওর পর্বত প্রমাণ দেহের তুলনায় আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র, অসহায়। সাহায্য করার মতো আসে পাশে কেউ নেইও।
“কবীর সাহেব, ওড়নাটা গলায় পেঁচান। নিন ধরুন।“
“কিহ কি শুরু করেছিস তুই? এমন পাগলামি শুরু করলি কেনো?”
“এতো বকবক করার মতো সময় আমার নেই। যা বলেছি তাই কর–তাড়াতাড়ি।“
অদৃশ্য দুটো হাত একটা সাদা ওড়না আস্তে আস্তে আমার গলায় পেঁচাচ্ছে। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। চোখে অবিশ্বাস আর বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে।
একটু একটু করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছি আমি। রায়হানের দিকে এখনো তাকিয়ে আছি আমি। শেষ মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম আমার সামনে ছুরি হাতে নিয়ে বসে থাকা মানুষটার দেহে প্রাণ নেই। আমার আগেই সে ছুটি নিয়েছে।
*
তীব্র আতঙ্কে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো আমি এই ধরণের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলাম। প্রতিবারই আমার প্রিয় কোনো মানুষকে নিয়ে। স্বপ্নের শেষে প্রতিবারই আমার মৃত্যু হয়। অথচ বাস্তবে হয় উলটো। যে আমাকে মারতে চেষ্টা করে, সেই মারা যায়। তার নিজেরই রুমের ভেতরে। গলায় ওড়না পেঁচানো, ঝুলন্ত। এই স্বপ্ন দেখে প্রতিবারই ঘুম–ভেঙে যায় আমার। তার পর পরই প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর আসে আমার কানে।
ঘুম ভেঙেছে আমার অনেক আগেই। অথচ এখনো আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। চোখ খুলতে তীব্র রকমের ভয় পাচ্ছি আমি। কারণ আমি জানি আমার রুমের ভেতরেই আছে একটা ঝুলন্ত লাশ। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর লাশ। কাল রাতে রায়হান আমার রুমেই ঘুমিয়েছিলো যে।
আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। শিউরে উঠলাম আমি আতঙ্কে। আমার সামনে আজ একটা নয়, দুটো লাশ। একটা রায়হানের আর একটা– আর একটা আমার নিজের।